Magic Lanthon

               

ইব্রাহীম খলিল

প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

নির্মাণ-বিনির্মাণের কসমিক সেক্স

নির্মাতা অমিতাভের ‘বাউল-বিরোধী’ আকাম

ইব্রাহীম খলিল


সত্য বল সুপথে চল

পৃথিবীতে নানা জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। তাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল হয়তো খুব সামান্যই; তবে তারা সবাই কিছু না কিছুর সন্ধান করে। যারা নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী, তারাও কোনো কিছু বিশ্বাস করে বা সন্ধান করে। কেনো করে সেটা ভিন্ন কথা। হতে পারে সেটা আত্মার ‘প্রশান্তি’ কিংবা বংশপরম্পরা। এর বাইরে যারা প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাদের অনেকে বস্তুবাদী ধারণাতেও অগাধ আস্থা রাখেন। বিশেষ করে বাউল-ফকিরি দর্শনে আলাদা তত্ত্ব ও দর্শন আছে, আছে সাধন পদ্ধতি ও সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাও, যারা মানব জন্মকে অসীম গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকেন। বাউল-ফকিররা মনে করেন, অনেক ভাগ্যের ফলে মানুষ এ মানবজীবন পেয়েছে। তাই এই মানব জন্মকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। লালনের ভাষায়-দেহ হলো খাঁচা, এই খাঁচার ভিতর ‘অচিন পাখি’ যাতায়াত করে। সে পাখিকে সহজে ধরা যায় না। তাই ‘মনো-বেড়ি’ দিয়ে সে ‘অচিন-পাখি’কে বাঁধার চেষ্টা করতে হয়।

প্রচলিত বা শাসকশ্রেণির ধর্মাচারের প্রতিবাদে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে এসব ‘লোকধর্মের’ সৃষ্টি হয়। তাই এর অনুসারীরা প্রচলিত সব ধর্মের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মতো বাউল-ফকিররাও ঈশ্বরকে পেতে চান; তবে সেটা মুরশিদ, সহজ মানুষ কিংবা মনের মানুষকে ভজন করে। বাউল-ফকিররা মনে করেন, সহজ মানুষকে পেতে হলে আগে চাই নিজ চিত্তকে পবিত্র করা, তারপর একাগ্রচিত্তে সেই সহজ মানুষকে সন্ধান করা। কিন্তু সন্ধান করলেই তাকে হাতের নাগালে পাওয়া এতো সহজ নয়। লালন ফকির তার কারণও শিষ্যদের বলে গিয়েছেন, ‘হাতের কাছে নড়ে চড়ে, খুঁজলে জনমভর মেলে না, সে কথা কয়রে দেখা দেয় না।’ তাই তাকে খুঁজতে হয় অধিক সতর্ক হয়ে সঙ্গোপনে, নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে, যার মূলে রয়েছে কামী থেকে নিষ্কামী হওয়া বা কামের ঘরে কপাট মারা।

বাউল-ফকিররা তাদের এ নিগূঢ় তত্ত্ব গোপন রাখার প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরেই রক্ষা করে আসছেন। যা বাইরের জগৎ থেকে অস্পষ্ট। কখনো যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করে, তাহলে আগে তারা দেখে নেন প্রশ্নকর্তা তাদের পথের পথিক কি না। কারণ সচরাচর অসম্প্রদায়ীদের কাছে হয় তারা কিছু বলেন না, না হয় উল্টোপাল্টা বলে বিভ্রান্তি এনে দেন। যাকে বলে আপ্ত সাবধান। আসলে এ উদাসীনতা কিংবা বিভ্রান্তি আনার মূল কথা হলো গোপনীয়তা। মানে ‘আপন কথা/ না কহিও যথাতথা/ আপনারে আপনি হুঁশিয়ার।’ কিন্তু সম্প্রতি বাউল-ফকিরদের এই নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়েই টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রনির্মাতা অমিতাভ চক্রবর্তী নির্মাণ করেছেন কসমিক সেক্স। এ চলচ্চিত্র নিয়ে চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক। এ লেখায় বাউল-ফকিরদের দেহ সাধনা ও সেই সাধনায় নারীর অবস্থান উপস্থাপন এবং এসব বিষয়ে নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শকের মনোভাব বিশ্লেষণের চেষ্টা থাকবে।

জলের ওপর পানি, না পানির ওপর জল

বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে বৈষ্ণব ও সুফিবাদ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কারণ বাউল-ফকিররা যে মত-পথের বিশ্বাসী সেটা এই দুই ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সনাতন ধর্মের দর্শন নিয়ে ষোড়শ শতকের দিকে বৈষ্ণব দর্শনের প্রবর্তন করেন শ্রীচৈতন্য দেব। নাম ও গুণকীর্তনের মাধ্যমে ভগবানের আরাধনা করার প্রক্রিয়াই এ ধর্মের মূল উপজীব্য। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, ভক্তি, জীবাত্মা ও পরমাত্মার তত্ত্ব সুরের মাধ্যমে তুলে এনে মানুষের মনে প্রবেশ করেন শ্রীচৈতন্য। বৈষ্ণব দর্শনে মনে করা হয়, জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। নিজেকে জানতে পারলে পরমাত্মাকে জানা যাবে। তারা বিশ্বাস করেন, ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টাকে পেতে হলে আগে ধরতে হবে একজন গুরু বা মুরশিদকে। যিনি পরমেশ্বরকে চিনতে সাহায্য করবেন।

অন্যদিকে সুফিবাদ ইসলামি আদর্শে গড়ে ওঠা অন্যতম আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক মতবাদ। এর জন্ম আরব ভূমিতে এবং পরিবৃদ্ধি পারস্য তথা ইরানে। পারস্যে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা হলে এর অধিবাসীরা বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ধর্মের প্রতি তারা তেমন অনুগত ছিলেন না। তাই নতুন-পুরাতনের সংঘর্ষে ও মিশ্রণে সেখানে ভিন্ন একটি ধর্মীয় আদর্শের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক হতাশায় পার্থিব সুখভোগের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ায় তাদের মনে সর্বেশ্বরবাদ ও বৈরাগ্যবাদ চেতনা জন্ম নেয়। এরাই পরে সুফি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি পায়।

একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আমাদের উপমহাদেশে আগত পির, দরবেশ, সুফিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পারস্যিক; যারা বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়কারী ও আধ্যাত্মিক দর্শনে বিশ্বাসী। এদের মধ্যে শাহ সুলতান রুমি, সৈয়দ শাহ সুরখ খুল অনতিয়হর, খাজা মইন উদ্দিন চিশতি, খাজা কুতুবউদ্দিন, শেখ বাহাউদ্দিন, শেখ ফরিদুদ্দিন ও নিজামউদ্দিন আউলিয়া অন্যতম। ইসলামে সংসার ত্যাগ নিষিদ্ধ থাকলেও এ সুফিরা সেটাকে বৈধতা দেন, এমনকি নিরামিষ ভোজনেও অনেকাংশে স্বীকৃতি দেন। এছাড়া ঈশ্বরকে পাওয়া বা স্মরণ করার অংশ হিসেবে বৈষ্ণব দর্শনের মতো তারাও সঙ্গীতের আশ্রয় নেন, যা কাওয়ালি নামে পরিচিত। সুফিবাদ অনুযায়ী, মুরশিদ বা গুরুকে স্মরণ করে তার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ বা আল্লাহর মধ্যে বিলীন হলেই ঈশ্বরের দেখা পাওয়া সম্ভব। তাই সুফিবাদকে ইসলামের প্রগতিশীল ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সনাতন ধর্মজাত বৈষ্ণব দর্শন, বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, ইসলামের সুফি মতবাদ যা মূলত মারফত বা মাইজভাণ্ডারি নামে পরিচিত-এই তিন ধারার মিলনে উদ্ভূত বাংলার ধর্মই হলো বাউল-ফকিরি দর্শন। তবে এই বাউল ও ফকিরি দর্শনের মধ্যেও আলাদা কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন, সত্যিকারের ফকির হলো আউল (আল্লাহ), বাউল (মুহাম্মদ), দরবেশ (আদম) ও সাঁই (আলি)। প্রথম তিন মত থেকে চতুর্থ মতের সৃষ্টি। আর বাউল হলো যারা গৃহহীন হয়ে ‘আধ্যাত্মিক’ সঙ্গীত চর্চা করেন এবং একই সঙ্গে দেহ সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে খোঁজ করেন। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য কথা বলেছিলাম যশোরে ফকিরি দর্শনে খেলাফতপ্রাপ্ত ফকির মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘ফকিরি দর্শন আসলে ইসলামের অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলে। কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে ও তাদের শিষ্যদের জ্ঞান দান করে। নামাজ-রোজাতেও তারা বিশ্বাস করে। অনেকে হয়তো শরিয়ত মেনে চলে না, তবে তাকে অস্বীকার করে না। যদিও অনেক সনাতন ধর্মের লোকও ফকিরি দর্শনে বিশ্বাস করে, তবে তারা শরিয়ত ব্যতীত মারফত, তরিকত ও হকিকত অনুযায়ী চলে। অন্যদিকে বাউলরা ইসলামের অনেক আচার মানলেও তাদের মধ্যে সনাতন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানই বেশি। তারা বৈষ্ণবদের মতো সঙ্গীত পছন্দ করে এবং তার মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করে। কিন্তু কোনো শাস্ত্রতেই তারা বিশ্বাস করে না। তবে সবচেয়ে বড়ো মিলের জায়গা হলো, বাউল ও ফকির উভয় সম্প্রদায়ের লোকই দেহ সাধনা করে।’

অনেকে লালনকে বাউল দর্শনের প্রবর্তক বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু লালন কখনো নিজেকে বাউল হিসেবে দাবি করেননি। বরং তার গানে নিজেকে ফকির বলে অভিহিত করেছেন। তাই ফকির ও দরবেশ হিসেবে লালনকে শনাক্ত করা সম্ভব হলেও ‘বাউল’ হিসেবে শনাক্ত করা যায় না, ‘হিন্দু’ বাউল তো নয়ই। বরং তিনি নিজেকে মুসলমান ও হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত করা থেকে সযত্নে বিরত থেকেছেন। কারণ হিন্দু-মুসলমান কোনো জাতের বর্গে তিনি অবস্থান করতে চাননি। আর তিনি এটাতে সফলও হয়েছেন। তবে বর্তমানে বাউল ও ফকিরি দর্শন অনেকটা মিলেমিশে একাকার। কারণ, ফকিরি দর্শনে ইসলামের অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চললেও তারা বাউলদের অনেক দর্শন মেনে চলেন, পক্ষান্তরে বাউলরাও। তাই লেখায় বাউল-ফকির একসঙ্গে এক অর্থে ব্যবহার করেছি।

বিন্দু থেকে বিন্দুধারণ

বাউল-ফকিররা সাধারণত তাদের মনের কথা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। তাই তাদের গানে আলাদা একধরনের ভাব লক্ষ করা যায়; যে ভাবে মিশে থাকে না-পাওয়ার বেদনা। বাউল-ফকিররা সাধনার অংশ হিসেবে নিজেদেরকে জীবাত্মা কল্পনা করে দেহের মধ্যেই পরমাত্মাকে অনুসন্ধান করেন। তবে সেটা মোটেই অনুমানের পথে নয়; তাদের সাধনার নাম ‘বর্তমান’। তারা বিশ্বাস করেন, দেহভাণ্ডে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ রয়েছে। তাই দেহকে নিয়ে সাধ্যানুযায়ী তারা নানা পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা করেন। দেহকে তারা নানা ভাগে বিভক্ত করে তার নামকরণও করেছেন। জীবনের মূল্যবান সময়টুকুই ব্যয় করতে থাকেন ছয় রিপু তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (অহঙ্কার) ও মাৎসর্য (পরশ্রীকাতরতা) দমনে। তাই কখনো তেলশূন্য, জটাযুক্ত রুক্ষ কেশ, অযত্নের গোঁফ কিংবা সুদীর্ঘ দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীর মূর্তি ধারণ করেন। বাউল-ফকিরকে দেখলে মনে হয়, তারা এ নশ্বর জগতের সুখ, দুঃখ, বিষাদ থেকে বহু দূরের কোনো জীব। সমাজ কর্তৃক কখনো তাদেরকে তিরস্কার করা হলে তারা হাসির মাধ্যমে তার প্রতিশোধ নেন। কোনো প্রশ্ন করলে একতারা বাজিয়ে চিন্তাশীল গানের মাধ্যমে তার জবাবও দেন। সঙ্কীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচাতেই তাদের আনন্দ।

বাউল-ফকিরের এই মারফতি তত্ত্বের মূল কথা হলো বিন্দুধারণ। দেহের উপরে চামড়া, সেই চামড়ার মধ্যে থাকে রক্ত, রক্তের মধ্যে মাংস, মাংসের মধ্যে মেদ, মেদের মধ্যে অস্থি, অস্থির মধ্যে মজ্জা, আর মজ্জার মধ্যেই সেই বিন্দু বা শুক্রের অবস্থান। যা উৎপন্ন হয় পঞ্চভূত থেকে। এই শুক্রের মধ্যেই থাকে প্রাণের বীজ। তাই শুক্রের অপচয় রোধ করাই বাউল-ফকিরদের প্রধান কাজ। কারণ শুক্রহানি ঘটলেই সহজ পথ থেকে সাধক টলে যান, মানুষ হত্যার মতো মহাপাপের সম্মুখীন হন। মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ছয় রিপুর মধ্যে শক্তিশালী রিপু হলো কাম রিপু। যেটা সাধনার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। আবার একে এড়িয়ে যাওয়াও কোনোভাবে সম্ভব নয়। এই কাম রিপুকে জয় করতে না পারলে ‘মনের মানুষ’কে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তাই এ দুর্বোধ্য জ্ঞানকে ফকিরি মতে বাতেনি, অপ্রকাশ্য বা নিগূঢ় তত্ত্বের জ্ঞান বলা হয়। পির বা মুরশিদকে ভজন করে সন্ধান করতে হয় এ নিগূঢ় তত্ত্বের। যারা জানেন তাদের ছাড়া আর কারো কাছে এ জ্ঞানের কথা বলা নিরাপদ নয়। লালন ফকিরের ভাষায়, ‘অবোধ অভক্ত জনা, তারে গুপ্ত ভেদ বলো না, শুনিলে সে মানিবে না, করবে অহঙ্কারী।’

কসমিক সেক্স ও নির্মাতার স্বাধীনতা

২০১২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ হওয়া কসমিক সেক্স মুক্তি পায় ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে। তবে এই মুক্তি কোনো প্রেক্ষাগৃহে নয়, অনলাইনে। নির্মাণ ও মুক্তিকালের মধ্যে এ দীর্ঘ ব্যবধানের কারণ সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেতে বিলম্ব হওয়া। পুতুল মাহমুদের প্রযোজনায় অমিতাভ চক্রবর্তীর পরিচালনায় এ চলচ্চিত্রের মূল বিষয় বাউল-ফকিরদের নিগূঢ় সাধনা। আঞ্চলিক ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের রিভিশন কমিটি চলচ্চিত্রটি দেখানোর বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেওয়ার পর পরিচালক অমিতাভ চক্রবর্তী সবাইকে জানিয়েছিলেন, ‘ছবিটি ‘এ’ সার্টিফিকেশন পেয়েছে। একথা ঠিক যে বেশ কিছু কাট দেওয়া হয়েছে। যেমন অধিকাংশ ফ্রন্টাল ন্যুডিটিই বাদ দিতে বলা হয়েছে বা ব্লার করে দিতে বলা হয়েছে। গান্ধী-সংক্রান্ত বেশ কিছু সংলাপও বাদ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ছবির বিষয় ভাবনা অর্থাৎ মূল গল্পের তেমন কোনোও ক্ষতি হচ্ছে না।’

শেষ পর্যন্ত কসমিক সেক্স-এর ‘শুদ্ধি’ আনয়নের জন্য ৩১টি জায়গায় কাঁচি চালায় সেন্সর বোর্ড। কাটাকাটির এতো উন্মাদনার পরও চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন অমিতাভ। তার আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো দর্শক যেনো তার চলচ্চিত্রটি দেখেন এবং গল্পটি অনুধাবন করতে পারেন। কারণ নির্মাতা হিসেবে সৃষ্টিকে মুক্তি দেওয়ার যে আকাক্ষা ও আনন্দ, সেটা অমিতাভের মধ্যে ছিলো পূর্ণমাত্রায়। কিন্তু এতো কাটাকাটি ও দৃশ্য ব্লার করার নির্দেশ অমিতাভ মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রটি মুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয়নি সেন্সর বোর্ড। এই ঘটনার পর এবার আর সেন্সর বোর্ডের অনুমতির জন্য অমিতাভ বসে থাকেননি। নির্মাতা হিসেবে তার পরাধীনতার মুক্তি ও সেন্সর বোর্ডের ‘ধৃতাত্মা’র প্রতিবাদ হিসেবে ১ ফেব্রুয়ারি অনলাইনেই মুক্তি পায় কসমিক সেক্স

সেন্সর বোর্ডের ৩১টি কাটের পরও চলচ্চিত্রটি কেনো মুক্তি পেলো না-এমন প্রশ্নে কসমিক সেক্স-এর ডিজিটাল মার্কেটিং-এর দায়িত্বে থাকা সৌম্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘বোধহয় বিষয়ের ওপর ভরসা করতে পারেননি কেউ। যখন প্রথাগতভাবে মুক্তির রাস্তা বন্ধ, খেয়াল করলাম আমাদের ওয়েবপেজ-এ সারা পৃথিবী থেকে উৎসাহী মানুষ কমেন্ট করেছেন, এবং তাঁদের বক্তব্য একটাই-আমরা ঢাকায় থাকি’ বা ‘আমরা আমেরিকায় থাকি’-কবে দেখতে পাবো ছবিটা?’ পরে দর্শকদের আগ্রহ দেখে অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশন করে ইন্টারনেটেই মুক্তি দেওয়ার কথা চিন্তা করেন নির্মাতা। সাহায্য চাইলে আমেরিকার ভি এইচ এক্স কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্লেয়ারে চলচ্চিত্রটিকে ‘এমবেড’ করে দেয়। ইন্টারনেটে একটা লেভেলের পর কোনো সেন্সরশিপ না থাকায় যাদের কাছে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড (ভিসা বা মাস্টার কার্ড) আছে, তারা অল্প কিছু ডলার দিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন। যেহেতু সার্ভারটি আমেরিকার, তাই ভারতীয় মুদ্রায় এটির মূল্য ধার্য করা সম্ভব হয়নি।

কসমিক সেক্স নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ইন্টারনেটে দেখা প্রথম কোনো বাংলা চলচ্চিত্র। অনলাইনে দুটি পদ্ধতিতে চলচ্চিত্রটি দেখার সুযোগ রাখা হয়েছিলো : ১. রেন্ট (rent) পদ্ধতি, যেখানে ৩.৪৯ ও ৪.৯৯ ডলারের বিনিময়ে চলচ্চিত্রটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে লগ-ইন করে তা দেখা যেতে পারে। তবে ডাউনলোড করা যাবে না; কারণ সেখানে পাইরেসির ভয় আছে। ২. সরাসরি ক্রয় করা, এটা পাঁচ আর ছয় ডলারের বিশেষ পরিসেবা। যেখানে চলচ্চিত্র ছাড়াও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত অন্যান্য ফুটেজ দেখা যাবে। একটু প্রিমিয়ামের দিকে ঝুঁকেই এই দাম ধার্য করা হয়েছিলো। চলচ্চিত্রের পুরো মার্কেটিংই ছিলো ফেইসবুকের মাধ্যমে। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যে ইউটিউবে এর সবগুলো ভিডিওই পাওয়া গিয়েছিলো। তবে দর্শক নির্মাতার এ সিদ্ধান্তকে হতাশ করেননি। মুক্তির প্রথম দিনেই চলচ্চিত্রের ওয়েবসাইটে এক লক্ষ হিট পড়ে। আর তিনশোর উপর দর্শক টাকা দিয়ে দেখেন চলচ্চিত্রটি। কলকাতার দর্শকের চেয়ে বেশি সাড়া ছিলো দিল্লি, মুম্বাই, পুনে ও বেঙ্গালুরু থেকে।

প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সেন্সর বোর্ডের চোখে আঙুল দিয়ে চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে হয়, সেটা অমিতাভ কসমিক সেক্স-এর মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে সৃষ্টিকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে পারলে স্রষ্টার যে আত্মতৃপ্তি, সেটাও অমিতাভের গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। আসলে একজন নির্মাতার কাছে সবচেয়ে আনন্দের ও তৃপ্তির মুহূর্ত সেটিই, যখন সে যেটা বলতে চায়, সেটা কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই বলতে পারে এবং অমিতাভ সেটা পেরেছেনও। অবশ্য এর জন্য তিনি কৌশিক মুখোপাধ্যায় ওরফে কিউ-এর কাছেও অনেকটা ঋণী। কারণ কিউ-এর গাণ্ডু কোনোদিনই অফিসিয়ালি মুক্তি পায়নি ভারতে। ওই চলচ্চিত্রটি অনলাইনেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিলো। উৎসাহী দর্শক টরেন্ট আর নানা পাইরেসি পোর্টাল থেকে ডাউনলোড করে চলচ্চিত্রটি দেখেছে। বহুজন ইউটিউবে বহুবার আপলোড করেছে। তাই বলা যেতে পারে, কিউ-এর পদক্ষেপ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ আর ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে এক নতুন পথের দিশারি, যা অমিতাভও অনুসরণ করেছেন।

অমিতাভ চক্রবর্তী চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন কাল অভিরাতির মাধ্যমে। সেটা ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের কথা। যেটা তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে জুরি অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। এর পর দীর্ঘদিন আর এ পথে হাঁটেননি তিনি। মূলত অমিতাভ পরিচিতি পান বাউল-ফকিরদের নিয়ে তৈরি বহু প্রশংসিত বিশার ব্লুজ নামের একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। কসমিক সেক্স তার নির্মিত দ্বিতীয় কাহিনিচিত্র। যেটা ইতোমধ্যেই অসিয়ান’স সিনেফ্যান ফেস্টিভাল অব এশিয়া অ্যান্ড আরব-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী শাখায় পুরস্কার লাভ করেছে। যাই হোক, আলোচনার আগে কসমিক সেক্স-এর কাহিনি সংক্ষেপ জেনে নিই।

বাবা ও বিমাতার সঙ্গে বাস করে মাতৃহীন যুবক কৃপা শঙ্কর রায়। একদিন গীর্জা কুমারের ‘ব্রহ্মচারী গান্ধী অ্যান্ড হিজ উইমেন অ্যাসোসিয়েটস’ বইটি পড়ে সে সেক্স সম্পর্কে জানতে উৎসুক হয়ে ওঠে। আলোচনার একপর্যায়ে জোর করে বিমাতাকে জড়িয়ে ধরলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাবা। উত্তেজনায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয় কৃপা। রক্তপাতে বাবার মৃত্যু হয়েছে ভেবে ঘর থেকে দৌড়ে পালায় সে। রাতে রাস্তায় চলতে চলতে পরিচয় ঘটে দেবী নামের এক যৌনকর্মীর সঙ্গে; সে ভালোবেসে কৃপাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। সে রাতেই তাদের মধ্যে ‘প্রেম’, তারপর সঙ্গম হয়! ঘটে নতুন বিপত্তি- যখন দেবীর দালাল, ‘যৌন প্রতিবন্ধী’ জোনাকি কৃপাকে দেখে পছন্দ করে। জোর করে চুম্বন করতে চাইলে ধাক্কা দিয়ে দোতলা থেকে জোনাকিকে ফেলে দেয় কৃপা। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে রাতের অন্ধকারে আবার দৌড়ে চলা! পরদিন সকালে গঙ্গায় স্নানরত এক নারীকে দেখে কৃপা তার মধ্যে মৃত মাকে খুঁজে পায়। সে নারীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে। যার নাম সাধনা। যিনি এক মারফতি ফকিরের কাছে লালিত-পালিত হয়ে তার কাছেই দেহ সাধনা ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের দীক্ষা নিয়েছেন। যিনি শিখেছেন কামকে উপেক্ষা করে নয়, বরং কামের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। আর এই সব দেহতত্ত্বের নানান কলাকৌশল পরম মমতায় কৃপাকে শেখায় সাধনা। চলে কৃপাকে পুনর্জন্ম দেওয়ার চর্চা।

সাধনায় নারী ও বাউলি বয়ান

উপমহাদেশে সাধনার ক্ষেত্রে নারীমুক্তির ‘বিশেষ পদ্ধতি’ নিয়ে আসেন ফকির লালন সাঁই। সাধনায় তিনিই প্রথম সেবাদাসী থেকে নারীকে গ্রহণ করেছিলেন সাধন-সঙ্গিনী হিসেবে। কিন্তু সে সাধন-সঙ্গিনী সময়ের বিবর্তনে পরিণত হয়েছে সাধকের সাধনার আধারে। তাই কাম বা দেহ সাধনায় সাধককে যা কিছু শিখতে হয়, তার কিছুই শিখতে হয় না তার সঙ্গিনীকে। তার স্থূল কিংবা পর্বত স্তর (বাউল-ফকিরি দর্শন অনুযায়ী স্থূল, পর্বত, সাধক ও সিদ্ধ নামে সাধনার চারটি স্তর রয়েছে। স্থূল ও পর্বত স্তর হলো সাধনার প্রাথমিক দুই স্তর। যেগুলো জেনে দেহ সাধনায় যেতে হয়।) নেই; সাধক স্তরে বাউল-ফকির পৌঁছালে তাকে কেবল গ্রহণ করা হয় সাধনার পাত্র হিসেবে। তাকে শেখানো হয় কীভাবে সাধকের নিম্নগতি রোধ করবে সে, কীভাবে দেহমিলনে সাহায্য করবে। ঠিক এমনই ভাবে বহু সাধক ও তার সঙ্গিনী সাধন-ভজন করে যাচ্ছেন। আবার অনেকে ফল লাভ কিংবা পরমাত্মার উপলব্ধি নয়, রাধা-কৃষ্ণের মিলনজনিত সুখকে নিজেদের মধ্যে অনুভব করে চলেছেন। ফলে নারী-রাধারা সাধক-কৃষ্ণকে ভজন করতে গিয়ে পরিণত হচ্ছেন চরণদাসীতে। এসব নারীদের গুরুর প্রতি রয়েছে অগাধ বিশ্বাস, গুরুর পথই তাদের পথ।

বাউল-ফকিরদের সাধনার জগতে ব্যভিচার মানেই পতন। আর একের পর এক পতন হলেই ‘আমার’ আমিত্ব থেকে দূরে চলে যাওয়া। তাই নিজের স্বরূপে পৌঁছাতেই প্রয়োজন এই দেহ সাধনার। এ সাধনার কঠিন পরীক্ষা হলো নিষ্কাম প্রেমের মাধ্যমে নারীকে স্পর্শ করা। তাদের ভাষায়, ‘শুদ্ধ প্রেম সাধবি যদি, কামরতি রাখ হৃদয়পুরে।’ কামকে জয় করে শুদ্ধ প্রেমজগতে পৌঁছানোই সাধকের লক্ষ্য। এই নিষ্কাম প্রেম-সাধনাতেই সাধন-সঙ্গিনী সাধককে নিয়ে যেতে পারে ঈপ্সিত লক্ষ্যে। বাউল-ফকিরের কাছে তাই তার সঙ্গিনী রাধারানি, চেতন গুরু।

প্রাণিবিদ্যা অনুযায়ী পৃথিবীর সমস্ত জীবকূল মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী-এ দু-ভাগে বিভক্ত। মেরুদণ্ড প্রাণীর বিবর্তনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মাথায় গিয়ে মিলেছে। যাকে বাউল-ফকিররা ত্রিবেণী বা মাকামে মাহমুদা নামে অভিহিত করে থাকেন। তাদের মতে, মানুষের শরীরে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নামের তিনটি নাড়ি রয়েছে। এর বাম দিকে ইড়া (উজান অর্থাৎ উপরের দিকে যাওয়ার পথ। এটা বাম শুক্রাশয়/ডিম্বাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত), ডান দিকে পিঙ্গলা (ভাটা অর্থাৎ নিচের দিকে নামার পথ। এটা ডান শুক্রাশয়/ডিম্বাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত) আর মাঝখানে সুষুম্না (একমাত্র খুঁটি, যাকে কেন্দ্র করে অন্য দুটির পথ চলা)। মেয়েদের ক্ষেত্রে জন্ম দরজায় এই তিন নাড়ি এসে মিলেছে। যাকে বাউল-ফকিররা বিভিন্ন গানে ত্রিবেণীর ঘাট বলে উল্লেখ করেছেন।

আবার এরাই হলো গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী। এখানেই মাসে মাসে জোয়ার বা রজঃ আসে। মাসিকের রক্ত পড়ার তিন দিনের শেষের দিন, যেদিন রক্ত পড়া কমে যায়, সেদিন ভাটির টানে আরশিনগর (দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান) থেকে ত্রিবেণীর ঘাটে নেমে আসেন স্রষ্টা। অনেকদিনের সাধনার পর সাধক তার দেখা পান। গানের ভাষায় তিনিই হলেন সাধকের কাঙ্ক্ষিত সেই মনের মানুষ বা সহজ মানুষ। রক্ত পড়ার তিন দিনকে বলা হয় অমাবস্যা। আর স্রষ্টার নেমে আসা হলো অমাবস্যায় চাঁদের উদয়। মিলনের সময় সাধকের কাজ হলো দেহ রসকে পিঙ্গলা পথে নামিয়ে এনে ইড়া পথে তুলে নিয়ে যাওয়া। এটা করতে করতে ইড়া ও পিঙ্গলা পথকে ত্যাগ করে মাঝখানের সুষুম্না পথে দেহ-রসকে তুলে নিয়ে যেতে হয়। যিনি পারেন তিনিই দেহ সাধনায় সফল সাধক।

মারফতি তত্ত্বের বিভিন্ন পদক্ষেপ শেষ করার পর শুরু হয় সাধনা জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই দেহ সাধনা, মানে কাম সাধনা। দেহ সাধনার শুরুতেই প্রয়োজন হয় একজন রজঃবতী নারী-সঙ্গিনী। কেননা যে নারীর রজঃ বন্ধ হয়েছে তিনি সাধনায় আর উপযোগী থাকেন না। কারণ সে নারী-সঙ্গিনীর ত্রিবেণীর ঘাটে স্রষ্টা আর নেমে আসেন ‘না’। সাধক যাতে ঈশ্বরের দেখা পান সেজন্য নারী-সঙ্গিনীকে বিভিন্ন দমের কাজ শিখতে হয়। সাধনার সময় কীভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে, কেমন আচরণ করলে, সাধক তার সাধনার পথ থেকে টলে যাবেন না, সেটা নারীকে আগেই শিখানো হয়। তাই সাধক ঈশ্বরের দেখা পাবেন কি পাবেন না, সেটা নারী সঙ্গিনীর ওপরই নির্ভর করে। লালনের ভাষায়, ‘যা ছুঁইলে প্রাণে মরি, এই জগতে তাইতে তরী’র মতো। কসমিক সেক্স-এ দেখা যায়, দেহ সাধনার সময় সাধনা কামাতুর হয়ে উঠলে গুরু তাকে বলেন,

তুমি কামের ফাঁদে পড়েছো। খবরদার শরীরের সুখের জন্য কামের ফাঁদে পড়ো না। সাধনা মা, দেহ সাধনায় নারী হলো গুরু, পুরুষ হলো তার শিষ্য। তোমার হাত ধরেই তো আমায় উজান ধারায় যেতে হবে মা। তুমি ধৈর্য হারালে আমি যে দিশেহারা হয়ে যাবো। দমের কাজ করো, বাঁ নাকে শ্বাস নাও, ডান নাকে শ্বাস ছাড়ো। দেহ সাধনায় সবচেয়ে বড়ো কাজ হলো দমের কাজ। এই দমকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের দেহের পতন বন্ধ করতে পারি।

সাধনা গুরুর শেখানো পথেই চলেন। বাম নাকে শ্বাস নিয়ে ডান নাকে ছাড়তে থাকেন। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গুরুকে নিরাকার ভেবে সাহায্য করতে থাকেন সাধকের ঈশ্বর দেখার বাসনায়। এভাবেই হয়তো যুগ যুগ ধরে সাধন-সঙ্গিনীরা তাদের সাধকদের ঈশ্বর লাভে সাহায্য করে আসছেন। প্রশ্ন হলো, সাধনায় নারীর অবস্থান কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা বলেছিলাম ফকিরি দর্শনে খেলাফতপ্রাপ্ত এবং এ দর্শনে বিশ্বাসী কয়েকজনের সঙ্গে। রাজশাহীর দুর্গাপুরের কানপাড়ার ফকির শামসুল সাঁই ২৯ বছর ধরে আছেন এই পথে। তিনি বলেন,

নারী ছাড়া একজন সাধক কখনোই দেহ সাধনা করতে পারেন না। দেহ সাধনায় সাধক নারীর ওপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভরশীল। সে সাধকের গুরু, যাকে এ পথে চেতন গুরু বলা হয়। ফলে যখন একজন সাধক তার সঙ্গিনীর সাহায্যে ঈশ্বরের দেখা পান এবং তাতে যে পূণ্য আসে সেটার অর্ধেক সেই নারী সঙ্গিনীও পায়। তবে তারা কাউকে বায়াত বা শিষ্য করতে পারেন না। কারণ, বাউল-ফকিরি দর্শন অনুযায়ী নারীদের এ অধিকার নেই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফকিরি দর্শনে বিশ্বাসী কয়েকজনকে একই প্রশ্ন করলে, প্রথমে তারা সাধনায় নারীর অনেক অবদানের কথা উল্লেখ করলেও শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে দেখার মতো সৌভাগ্য যে নারীরা পান না, সেটা স্বীকার করেন।

প্রায় ৩০ বছর ধরে সাধকের সঙ্গিনী হিসেবে সংসার করা যশোরের চৌগাছার ফকিরি দর্শনে খেলাফতপ্রাপ্ত ইসহাক ফকিরের সহধর্মিনী ফাতেমা বেগমকে একই প্রশ্ন করা হয়। সাধনায় নারীর অবস্থান, মর্যাদা এবং কীভাবে তারা অবশ্যম্ভাবী-এসব বিষয় তিনি নানা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন। নারী যদি ঈশ্বরকে না-ই দেখতে পায়, তাহলে সাধনায় তার প্রাপ্তি কী-এমন প্রশ্ন করলে হঠাৎ-ই তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, ‘আমি আসলে এতদিন এভাবে ভাবিইনি, নারী কেনো ঈশ্বরকে দেখতে পাবে না। এতদিন যে ফকিরকে সাহায্য করে যাচ্ছি, তাতে আমার লাভ কী? দেখি তো ফকিরকে বললে সে এর কী উত্তর দেয়।’

কসমিক সেক্স-এর এক ঘণ্টা এক মিনিটে সাধনাকে দেখা যায়, বিবস্ত্র হয়ে কৃপাকে দেহ সাধনার প্রাথমিক জ্ঞান দিতে। আলোচনার একপর্যায়ে মহাত্মা গান্ধীর ব্রহ্মচর্যের প্রসঙ্গ উঠলে সাধনা কৃপাকে বলেন, ‘মহাত্মা গান্ধীর কথা বলছো? তিনি কি কখনো গুরু ধরে নারী সঙ্গ করে নিজের ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন? নিজের প্রকৃতিকে কী চোখে দেখতেন তিনি-সেটাই আসল। প্রকৃতি ত্যাগ করে কখনো ব্রহ্মচর্য রক্ষা করা যায় না।’ তার মানে অমিতাভ বাউল-ফকিরি দর্শন থেকে বুঝতে পেরেছেন যে, দেহ সাধনার আগে একজন গুরু ধরতেই হবে এবং সেটা পুরুষ গুরু; তারপর নারীসঙ্গ। কিন্তু চলচ্চিত্রটির এক ঘণ্টা আট মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে দেখা যায়, সাধনা কৃপার সঙ্গে ‘দেহ সাধনা’ করছেন। কাহিনির এক ঘণ্টা ১৪ মিনিট আট সেকেন্ডে সাধনা তার জন্মদ্বারের দিকে ইঙ্গিত করে কৃপাকে বলেন, ‘এখানেই মাসে মাসে জোয়ার আসে। আমাদের মাসিকের রক্ত পড়ার তিন দিন, যেদিন রক্ত পড়া কমে যায়, সেদিন ভাটির টানে এইখান থেকে (মাথার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে) নেমে আসেন স্রষ্টা, ত্রিবেণীর ঘাটে। অনেক দিনের সাধনার পর সাধক তার দেখা পান। গানের ভাষায় তাকে মনের মানুষ, সহজ মানুষ বলে।’

যখন এ কথাগুলো সাধনা বলতে থাকেন, তখন সাধনার দু-চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে। বুঝতে কষ্ট হয় না তিনি সাধককে ঈশ্বরের দেখা পাইয়ে দিতে কতো নিবেদিত প্রাণ। আসলেও তাই; সাধকের সঙ্গিনীর খোঁজ থাকে রজঃবতী হয়নি এমন মেয়ের দিকে। তবে সেটা নিজের জন্য নয়, সাধকের জন্য। কারণ, এমন মেয়ের প্রথম রজঃ, যাকে ‘অমিলা রস’ বলে, তা পান করলে সাধক নিরোগ হন, দীর্ঘায়ু হন; সাধনা করতে অসীম শক্তির অধিকারী হন। তাদের মতে, শরীরের ভিতরে এই রজঃর নাকি বিশেষ ক্রিয়া আছে। তাই সাধকের ঈশ্বরকে না পাওয়ার বেদনা সঙ্গিনীকে ব্যথিত করে! এই হলো বাউল-ফকির দর্শনের নারী।

অমিতাভ চার-পাঁচ বছর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বাউল-ফকিরদের এই দর্শন নিয়ে নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র বিশার ব্লুজ। এখান থেকেই বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্ব নিয়ে নির্মাণ করেছেন ফিকশন বা কাহিনিচিত্র কসমিক সেক্স। বাউল-ফকিরদের নিয়ে সামগ্রিক রিপ্রেজেন্টেশন তার এ চলচ্চিত্রে দেখা যায়। দুই বাংলায় বাউল-ফকিরি দর্শন নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও তাদের সর্বোচ্চ সাধনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি বললেই চলে। যতদূর মনে হয়, দেহতত্ত্বের সাধনা নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র এটিই প্রথম। এখন দেখার বিষয় অমিতাভ সেটা কীভাবে পরিপূর্ণ করেছেন; অর্থাৎ বাউল-ফকিরদের নিগূঢ় তত্ত্বকে সেলুলয়েডে তিনি কীভাবে তুলে এনেছেন।

দেহ সাধনা নাকি যৌন সাধনা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফকিরি দর্শনে বিশ্বাসী প্রত্যন্ত অঞ্চলের অখ্যাত এলা ফকির একবার লেখক সুধীর চক্রবর্তীকে বাউল-বৈরাগীদের ভণ্ডামি সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছিলেন, অনেক বাউল-বৈরাগীই উদাসীন সেজে বসে থাকেন। সাধারণত এ বাউল-বৈরাগীরা পাঁচ রকম-চ্যাটাস্তি, প্যাটাস্তি, মালাটেপা, ওষুধবেচা আর আল্লাখ্যাপা। এদের মধ্যে বেশিরভাগই প্যাটাস্তি, মানে পেটের ধান্দায় ভেক নিয়েছেন। খাওয়া ছাড়া এরা আর কিছুই বোঝেন না। আর মালাটেপা মানে ভিতরে ঢুঢু; শুধু চোখ বুজে তসবি মালা টেপেন। ওষুধবেচা হলো, এরা কতোগুলো জড়িবুটি নিদেন-পথ্য জানেন এবং সেগুলোই বেচে খান। আর আল্লাখ্যাপা মানে গেঁজেল; সাধন-ভজনের চেয়ে গাঁজা, সিদ্ধির দিকেই ঝোঁক বেশি। সর্বশেষ চ্যাটাস্তি; মানে ধর্মের নামে মেয়েমানুষকে ভোগ করে যারা। এর বাইরে যে আরেক ধরনের বাউল-ফকির আছেন, তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হয় জীবন ও আত্মার অনুসন্ধানের জন্য।

সে সন্ধানেরই ধারাবাহিকতায় কসমিক সেক্স-এর ৩২ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে সাধক রুহুল ফকির শিষ্য সাধনাকে দেহ সাধনার আগে এ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেন। সাধনা দেহ সাধনা সম্পর্কে কিছু জানে কি না সেটাও ঝালিয়ে নেন। কারণ একজন ‘মূর্খ’ সঙ্গিনীর সঙ্গে তো আর দেহ সাধনা হয় না! যাই হোক, রুহুল ফকির ঈশ্বরকে চেনা ও কীভাবে তাকে পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সাধনাকে বলেন,

আমাদের ফকিরি মতে বলে, সৃষ্টির সময় যেই বস্তু ধারণ করে এই বিশ্ব জন্ম নিলো, সেই বস্তুর এখনকার রূপ আমি। আর যেহেতু তার থেকেই আমার উদ্ভব, তাই বলা যায় আদিতে আমিই ছিলুম। কিন্তু সৃষ্টির ক্রমাগত রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় সেই সূক্ষ্ম আমি স্থূল হতে হতে, দূরে যেতে যেতে, আমি আমার নিজের মূল সত্তাকে ভুলে গেছি। এখন এ সৃষ্টির উল্টো পথে গিয়ে আমার ভিতরের স্রষ্টা আর শক্তির সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়ে আমি আমার সে ভুলে যাওয়া সত্তার সঙ্গে মিলতে পারবো। তাহলে বুঝতে পারছো মা? যাকে স্মরণ করছি সেই সত্তা আমি, আবার যে স্মরণ করছে সেই সত্তাও আমি। ওই সত্তা নিরাকার, এই সত্তা সাকার। তাই মানুষ একই সঙ্গে সাকার, নিরাকার; গুপ্ত, ব্যক্ত। তবে এই মানুষ হবার পথে কামই সবচেয়ে বড়ো বাধা।

কাহিনির ৩৭ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে টিল্ট ডাউন শটে দেখানো হয়, ঘরের উন্মুক্ত দরজার সামনে গুরু রুহুল বাবা ও সাধনা ‘দেহ সাধনা’ করছেন। এ সময় সাধনা কামাতুর হয়ে উঠলে কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেন গুরু। এর পর সাধনা আর কামাতুর হয়ে ওঠেন না। গুরুর সঙ্গে ‘দেহ সাধনায়’ ঈশ্বর সন্ধানে ডুব দেন। কাম সাধনা যেহেতু বাউল-ফকিরি দর্শনের প্রধান ও সর্বোচ্চ সাধনা, তাই সাধনাকে অনেক যত্ন ও ভক্তি সহকারে শেখান রুহুল ফকির। প্রশ্ন হলো, বাউল-ফকিরি দর্শন অনুসারে রুহুল-সাধনা কাম সাধনা করতেই পারেন; তবে সেটা পুরো ঘর ছেড়ে উন্মুক্ত দরজার সামনে কেনো? যেহেতু কাম বিষয় হিসেবে যেমন গুপ্ত, তেমনই সাধনা হিসেবেও গুপ্ত; তাহলে এ গুপ্ত বিষয়টি উন্মুক্ত করায় নির্মাতার আসল উদ্দেশ্য কী? তিনি কি বাউল-ফকিরি দর্শনের সঠিক পথ দেখাতে চান, নাকি সে পথ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে চান?

চলচ্চিত্রের ২১ মিনিট আট সেকেন্ডে নদী থেকে সকালে গোসল করে আসার সময় সাধনার সঙ্গে কৃপার প্রথম দেখা হয়। তারপর প্রথম রাতেই ভাত খেয়ে কৃপাকে নিজের ঘরে আসতে বলেন সাধনা। সে ডাকে সাড়া দিয়ে এক ঘণ্টা এক মিনিটে সাধনার ঘরে কৃপা গেলে, সেখানে বিবস্ত্র সাধনা দেহ সাধনার জ্ঞান দিতে থাকেন কৃপাকে। কারণ প্রস্তুত না হয়ে দেহ সাধনায় গেলে কাম সাগরে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে! ঘটনার পরদিন রাতেই অর্থাৎ এক ঘণ্টা আট মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে দেখানো হয় সাধনা-কৃপার ‘দেহ সাধনা’। প্রাথমিকভাবে অমিতাভের কাছেও হয়তো এর সবকিছুই ঠিক মনে হতে পারে। কারণ দেহ সাধনার আগে কিছু তাত্ত্বিক জ্ঞান তো কৃপাকে দেওয়া হয়েছেই। তারপর সে জ্ঞানের প্রয়োগ হচ্ছে!

কিন্তু এখানে দেখার বিষয়, সাধনা কীভাবে কাকে বাউল-ফকিরি দর্শনের সবচেয়ে গোপন ও সর্বোচ্চ শিক্ষাটা দিচ্ছেন। কিংবা যেভাবে তিনি এই শিক্ষা দিচ্ছেন, তা এই দর্শন সমর্থন করে কি না? কারণ এ দর্শনের প্রথম শর্ত, যার সঙ্গে সাধনায় লিপ্ত হবেন (নারী, পুরুষ উভয়), তাকে সবার আগে এ পথের পরীক্ষিত পথিক হতে হবে। তারপর দেহ সাধনায় উপযোগী করে তুলতে হবে শরীর ও মনকে। সমস্ত দিক প্রস্তুত হলেই কেবল গুরু তাকে দেহ সাধনার নির্দেশ দিবেন এবং কীভাবে তা করতে হয় দেখিয়ে দিবেন। তবে খুব সহজেই এই সাধনার উপযোগী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এ দর্শনে সাধনার জন্য উপযোগী হতে কারো দুই থেকে ২০ বছরও লাগতে পারে, আবার সারাজীবনে কেউ উপযোগী নাও হয়ে উঠতে পারে। কেউ যদি অপরিচিত বা তাদের পথানুসারী নয় এমন কাউকে এ জ্ঞানের ইঙ্গিতও দেন, তাহলে তিনি বাউল-ফকিরি দর্শনের নিয়ম ভঙ্গ করলেন।

কসমিক সেক্স-এ সাধনা বাউল-ফকিরি দর্শনের প্রথম শর্তই ভঙ্গ করেন। কারণ তিনি যে কৃপার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রথম রাতেই বিবস্ত্র হয়ে দেখা দিলেন, সে তো বাউল-ফকিরি দর্শনে বিশ্বাসী নয়। একই সঙ্গে সে বাউল-ফকিরি দর্শনের কিছুই জানে না এবং তা জানতে আগ্রহ প্রকাশও করেনি। যদি সে আগ্রহ প্রকাশ করতো, তাহলেও প্রথম রাতেই বিবস্ত্র হয়ে শিক্ষা দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা এ দর্শন সমর্থন করে না। হ্যাঁ, সাধনা দেহ সাধনা শিখিয়ে কৃপাকে ঈশ্বরের দেখা পাইয়ে পুনর্জন্ম দিতেই পারেন। কিন্তু তা কোনোভাবেই বায়াত বা মুরশিদ হওয়ার আগে নয়। সাধনা নিজেই যেখানে সেই আট থেকে ‘১৮ বছর’ বয়স পর্যন্ত গুরুর সঙ্গে বিভিন্ন আখড়ায় ঘুরে বাউল-ফকিরি দর্শন সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েছেন, সেখানে তাকে দিয়েই অমিতাভ কীভাবে সম্পূর্ণ অচেনা কৃপার সঙ্গে দেহ সাধনা দেখান!

ফকির শামসুল সাঁইয়ের মতে,

সাধনা এখানে সম্পূর্ণ ব্যভিচার করেছে। কারণ অচেনা কিংবা ‘মূর্খ’ কোনো ব্যক্তিকে এ জ্ঞান শিখানো কিংবা তার সঙ্গে চর্চা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সাঁইজির মত অনেক সূক্ষ্ম। তারণ্য, কারণ্য ও লাবণ্য ২৪ ঘণ্টা পর পর একটা ধারা প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে সরল আসবে, গরল আসবে, মীন আসবে। এই মীনের মধ্য দিয়েই সাঁইজি আসেন। তাকে চেনাই সাধকের সবচেয়ে বড়ো কাজ। আর সেটা যদি ভালোভাবে গ্রহণ না হয়, তাহলে গরল খেয়ে প্রাণনাশ হবে। কাম তো নিষ্কাম হবেই না বরং তার কাম প্রবৃত্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে কোনো নারীসঙ্গিনী যদি নিজেকে হেফাজত করতে না পারে, তাহলে সে কলঙ্কিত নারীতে পরিণত হবে।

হ্যাঁ, কৃপা কোনো কারণে সাধনার কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো। কিন্তু সে সাধনার কাছে কখনোই দেহ সাধনা শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

তাহলে সাধনা তাকে কেনো এ জ্ঞানের সন্ধান দিলেন? অমিতাভ কি সাধনাকে দিয়ে দেহ সাধনা দেখালেন, নাকি সাধনার নামে যৌন সাধনা দেখালেন? তিনি কি বাউল-ফকিরি দর্শন প্রচার করলেন, নাকি ‘অমিতাভীয় দর্শনের’ বিকাশ ঘটালেন। যদি নিজের দর্শনই তিনি প্রচার করতে চান তাহলে বাউল-ফকিরি নামের ব্যবহার কেনো?

এ কোন আজব কারখানা

কসমিক সেক্স-এর ৪৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডে রুহুল ফকির মৃত স্ত্রী আমেনার প্রতি ভালোবাসার কারণে পাঁচ মাইল দূরে তার গ্রামে দৌড়ান। কারণ তিনি জানতে পেরেছেন, গ্রামবাসী তার ফকিরি দর্শনে বিশ্বাসের জন্য স্ত্রী আমেনাকে কবর পর্যন্ত দিতে দিচ্ছে না। তাই কারো সাহায্য ছাড়াই কাঁধে স্ত্রীর লাশ এনে আশ্রমের সামনে কবর দেন রুহুল। একপর্যায়ে স্ত্রীর শোকে পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সে ধাক্কা রুহুল ফকির সামলাতে পারেন না। সমস্ত দর্শন ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। রুহুল হয়তো বাউল-ফকিরের সংসারত্যাগী দর্শনে বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই তার স্ত্রী, সংসারের কোনো খবর নিতে পারেননি। কিন্তু স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি এতটুকু।

৫৫ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন সাধনা সবার বিরোধিতা সত্ত্বেও রুহুল বাবার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মুখ স্ত্রী আমেনার দিকে ঘুরিয়ে দেন। কারণ হিসেবে সাধনা বলেন, ‘আমাদের মতো গরিব আর নীচু জাতের মানুষেরা, যারা চিরকাল ধর্মের নামে লাথিঝাঁটা খেয়ে এসেছি, লোকের অপমান শুনে এসেছি। আমার গুরুর শেষ ইচ্ছা ছিলো তার কবর যেনো এই ধর্মের নামে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে থাকে।’ প্রশ্ন ওঠে, দাফনের সময় মৃত ব্যক্তির মুখ কেবলার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার রীতি থাকলেও এখানে স্ত্রীর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো কেনো? আবার যার দিকে ‘নিয়ম’ ভেঙে মুখ ঘোরানো হলো, সে তো এ দর্শনেই বিশ্বাসী নয়!

বাউল দর্শনে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ দর্শনে বিশ্বাসী এই লোকগুলোর কাছে কে হিন্দু, কে মুসলমান কিংবা কে শরিয়তপন্থি, মারফতপন্থি সেটা কোনো দিনই মুখ্য ছিলো না। রুহুল ফকিরও সেই পথেই হেঁটেছেন, বরঞ্চ সেই অবস্থান থেকে তিনি আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছেন। সব প্রথা ভেঙে মানুষকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছেন। তাই সাধারণ বাউল-ফকির দেহত্যাগ করলে যে নিয়ম মেনে কবর দেওয়া হয়, সেটাকে উপেক্ষা করেছেন রুহুল। শরিয়ত-মারফত, নারী-পুরুষ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ‘যে মানুষে, মানুষ সৃষ্টি’ তাকেই পরমাত্মা জ্ঞান করেছেন; আর তার দিকেই মুখ ঘুরিয়ে দিতে শেষ বিদায়ে নসিহত করে গেছেন। ফলে রুহুলের কেবলা হয়েছে ‘মানুষ’, তার স্ত্রী নয়। তার মানে যে নিরাকার ঈশ্বরকে তিনি স্মরণ করেছেন, তাকেই আবার সাকার করে পেয়েছেন এই মানুষের মধ্যেই।

নির্মাতা অমিতাভও প্রথা ভেঙে মানুষের মধ্যেই নিরাকার ঈশ্বরকে পাওয়ার সাহস দেখান। নির্মাতা হিসেবে তার যে ক্ষমতা, সেখান থেকে নতুন চিন্তা করেন। প্রজন্ম-প্রজন্ম পর বাউল-ফকিররা যা করতে পারেননি, তাই করে অমিতাভ অঁতর নির্মাতা হয়ে ওঠেন।

মানুষের মতো দেখতে

তবে ‘মানুষ’ নয়

প্রেম-ভালোবাসা-আসক্তি; এগুলো সমার্থক অর্থে ব্যবহার হলেও আসলে এর মধ্যেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। প্রেম হলো দুটি সত্তার মধ্যে ‘মানসিক’ আকর্ষণ। যে আকর্ষণে এক অপূর্ণ সত্তা অন্য সত্তার সঙ্গে মিলে পূর্ণতা আনতে চায়। অর্থাৎ আপন সত্তার অপূর্ণতা অনুভব করে, সেই সত্তার পূর্ণতা আনার যে আকর্ষণ তাই প্রেম। অন্যদিকে ভালোবাসা হলো মানুষের আবেগ অনুভূতির স্বাভাবিক রূপ। বিশেষ কোনো ‘সাবজেক্ট’, যেমন : ব্যক্তি, ঘটনা, প্রাণী, স্মৃতি ইত্যাদির ব্যাপারে মানুষের বিশেষ অনুভূতির নামই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা প্রেমের চেয়ে উদার, কিন্তু গভীর নয়। কারণ কেউ চাইলেই আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বতের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি করতেই পারে, কিন্তু প্রেম করতে পারে না। কারণ ভালোবাসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একরৈখিক। আর প্রেম উভয়ের মিলনের গভীর প্রচেষ্টা। ভালোবাসা থেকেই প্রেমের উৎপত্তি, প্রেম থেকে ভালোবাসা নয়। আর আসক্তি বা কাম হলো ক্ষণিকের মোহ। এই মোহ ভালোবাসাও নয়, প্রেমও নয়; এটা ক্ষণস্থায়ী; জৈবিক চাহিদা মেটানো বা সম্ভোগেচ্ছা।

কসমিক সেক্স-এর মূল উদ্দেশ্য বাউল-ফকিরি দর্শন অনুসারে কীভাবে একজন সাধক কামের মাধ্যমে ঈশ্বরের পূর্ণ আত্মার প্রেমে পড়ে তার অপূর্ণ আত্মার মিলন ঘটায় সেটা দেখানো। এরই ধারাবাহিকতায় নির্মাতা রুহুল-সাধনা ও কৃপা-সাধনার দেহ সাধনা দেখিয়েছেন। অমিতাভ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, ‘যৌনতা এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয় নয়। তারা এখানে দেখাতে চেয়েছেন উপমহাদেশে বাউল-ফকিরদের মধ্যে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা দেহ সাধনাকে।’ চলচ্চিত্রের নয় মিনিট ২৫ সেকেন্ডে কৃপার সঙ্গে রাস্তায় সাক্ষাৎ হয় দেবীর। যে দেবী নিজেকে তার কাছে পরিচয় দেন শহরের ‘টপ খানকি’ বা যৌনকর্মী হিসেবে।

একপর্যায়ে কৃপাকে নিজের ঘরে নিয়ে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন দেবী। দেবীরূপী পাপিয়া ঘোষাল তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি হঠাৎ-ই কৃপার প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেটা শুধু যৌন সম্পর্কের ভালোবাসাই ছিলো না। সাধনার অংশ হিসেবেই তিনি কৃপার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।৯ চলচ্চিত্র কিন্তু এই বক্তব্যকে রিপ্রেজেন্ট করে না। রাস্তা থেকে নিজ কক্ষে এনে স্বল্পবসনে নাচানাচির পর দেবী যেভাবে কৃপাকে দিয়ে স্তন লেহন করান সেখানে সাধনাটা ঠিক কোথায়, বোঝা যায় না! আর দেবীইবা হঠাৎ করে এই সাধনা করতে যাবেন কেনো, তিনি তো নিজের পরিচয় দিচ্ছেন যৌনকর্মী হিসেবে! তাহলে দেহ সাধনা বলতে অমিতাভ নিজে কী বুঝলেন, আর দেবীকেইবা কী বোঝালেন!

‘যৌন প্রতিবন্ধী’ জোনাকি ১১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে দেবীর সঙ্গে হাজির হন পর্দায়। পোশাক আর কথা শুনে তাকে যৌন প্রতিবন্ধীই মনে হয়েছে। আবার যেভাবে পাঁচ জন পুরুষকে নিয়ে জোনাকি ঘুরে বেড়ান, তাতে তিনি সমকামিও হতে পারেন। তার শারীরিক কাঠমো পুরুষ; কিন্তু মানসিকভাবে তিনি হয়তো নারী। তাই চলচ্চিত্র জুড়ে তিনি বার বার নিজেকে রাধা মনে করে কৃষ্ণ-কৃপাকে ভালোবাসতে চেয়েছেন। প্রকৃতিগতভাবেই প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ দুই সত্তাই অবস্থান করে। যার মধ্যে যেই ভাবটা বেশি সেটার দ্বারাই তিনি লৈঙ্গিক পরিচিতি পান। অর্থাৎ শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও ভিতরের নারী ভাবটা থাকার কারণে তিনি নারী হতে চান বা নারীর মতো আচরণ করে থাকেন। পক্ষান্তরে শারীরিকভাবে পরিচিত কোনো নারীর ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটতে পারে। এছাড়াও শারীরিক ও সাধনার কারণে অনেকে নপুংসক কিংবা নপুংসক ভাব আনতে পারেন। আবার ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণেও অনেকে যৌন প্রতিবন্ধী হতে পারেন।

কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ এই আইডেন্টিটির কোনোটিই মেনে নিতে চায় না। তারা সবসময় নির্দিষ্ট লৈঙ্গিক পরিচয় এবং এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট যৌন সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়ার চর্চা করে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে হাজির থাকে  সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মালিকানা। যার কারণে সমাজ তার বাইরে পুরুষ-পুরুষ (গে) কিংবা নারী-নারীর (লেসবিয়ান) মধ্যকার যৌন সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চায় না। একই সঙ্গে এ সম্পর্কগুলোকে ঘৃণার চোখে দেখে, সেই ঘৃণার একটা চর্চা সমাজে-রাষ্ট্রে অব্যাহত রাখতে চায়। কারণ এর সঙ্গে শারীরবৃত্তিয় বৃহৎ রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

এদিকে বাউল-ফকিরি দর্শন মতে, মানুষ একই সঙ্গে নারী, পুরুষ ও নপুংসক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। অর্থাৎ একজন মানুষ লৈঙ্গিক পরিচয়ের এই তিনটি রূপই ধারণ করে। বাউল সাধনার ক্ষেত্রে এ মানুষের অবস্থান কোথায়? এমন প্রশ্নে শামসুল ফকির বলেন,

সাঁইজি নপুংসকদের সাধনার কথা আলাদা করে তেমন কিছু বলে যাননি। তবে ওদের একটা ভাব আছে সেই ভাবকে বিলীন করে দেওয়ার কথা বলেছেন। ওদের মধ্যে নারী ও পুরুষ দুই ধরনের ক্ষমতা বিরাজ করে। কোন ভাবটা প্রবল সেটা আগে দেখতে হবে। তার সঙ্গে যদি কারো ভাব হয়, তবে সে তার সেই সঙ্গীর সঙ্গে সাধনা করতে পারে।

জোনাকিও সেই সুরে মিল রেখে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আই অ্যাম নাথিঙ, নাই না স্ত্রী, নাই না পুরুষা, নাই না শিখণ্ডি এ বচা। আমি শিখণ্ডীও নই, পুরুষও নই, নারীও নই। আমি, আমি।’১০ তাই হয়তো চলচ্চিত্রে জোনাকি বার বার কৃপাকে কাছে চেয়েও যখন পান না, তখন জোর করে কৃপাকে কৃষ্ণ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। সাধনা বাধা দিলে জোনাকি বলেন, ‘মাগো তুমি তো এক নারী, আমার মধ্যেও এক নারী আছে, আমারও স্নেহ-ভালোবাসা আছে; তুমি বোঝো না? আমি যে ওর প্রেমিকা। প্রেম কি শুধু শরীরের, অন্তরের নয়?’

জোনাকির অন্তরের এই চাওয়া যথার্থই। তবে সে চাওয়াটা কীভাবে হচ্ছে এবং চলচ্চিত্রে তার রিপ্রেজেন্টেশন কীভাবে হয় সেটা দেখার বিষয়। কাউকে এক নজর দেখে যে কারো ভালোলাগা, তারপর তার প্রতি ভালোবাসা জন্মাতেই পারে, তবে সেটাকে প্রেম বলা যাবে কি? কারণ প্রেম হতে হলে সেটার দ্বিপাক্ষিক সাড়া প্রয়োজন। কিন্তু চলচ্চিত্র জুড়ে জোনাকি যেভাবে বেয়াড়া আচরণ করে পাগলের মতো কৃপাকে পেতে চান, সেটা ভাবনার উদ্রেক করে। এই উপস্থাপন শরীর বা দেহের যে রাজনীতি সেটাকে সমাজে আরো বদ্ধমূল করে। আমাদের মাথার মধ্যে নারী-পুরুষ এবং তাদের যৌন সম্পর্ক নিয়ে যে ধারণায়ন, আরো প্রথাবদ্ধ করে সেটাকে।

ফলে জোনাকি যখন কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য কৃপার পিছনে ছুটে বেড়ায়, প্রতিহিংসাবশত সাধনাকে খুন করে, তখন নারী ও পুরুষের প্রথাগত যৌন সম্পর্কের বাইরে আর যা যা আছে তা কতোটা ‘নোংরা’, ‘নৃশংস’ কিংবা ‘বেলেল্লাপনা’ সেটা প্রমাণ করতে কষ্ট হয় না। একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, একজন রাধার কতো জন কৃষ্ণেরইবা প্রয়োজন? জোনাকি সার্বক্ষণিক যেভাবে পাঁচ জন পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান সেটাও এই লৈঙ্গিক পরিচয় সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণাগুলোকেই প্রতিষ্ঠিত করে। একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে ‘হিজড়া’খ্যাত যৌন প্রতিবন্ধী এই মানুষগুলো সমাজে যেভাবে ‘মানুষ’ না হয়ে ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত হয়, সেটাও এর মধ্য দিয়ে বৈধতা পায়। এর আড়ালে চাপা পড়ে যায়, সমাজে ‘হিজড়া’র পরিবার ও তাদের নিয়ে যে তামাশা চলে সেই নির্মম রূপটি। অথচ প্রথা ভাঙা অঁতর নির্মাতা অমিতাভ কেনো জানি সেই পথেই হাঁটেন!

অবোধ অভক্ত জনা

তারে গুপ্ত ভেদ বলো না

এই প্রবন্ধের অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রটি নিয়ে সাধারণ দর্শকের (মানে এই দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়) মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন ২০১৫) কসমিক সেক্স দেখেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের (ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, বাংলা এবং উদ্ভিদবিদ্যা) এমন ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা হয়, যাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়েই রয়েছে।

‘চলচ্চিত্রটি কেমন লেগেছে’-এমন প্রশ্নের উত্তরে পাঁচ জনের মধ্যে এক ছেলে শিক্ষার্থী বলেন, ‘চলচ্চিত্রটি আমি প্রথমে সেভাবে বুঝতেই পারিনি। তবে দেখার পর চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে হস্তমৈথুনও করতে হয়। প্রথমবার দেখার কয়েকদিন পর অনেকের কাছে চলচ্চিত্রটির আলোচনা শুনে বুঝতে পারি এটা আসলে বাউল-ফকিরদের দেহ সাধনার পদ্ধতি।’ বাকি চার জনের তিন জন জানান, চলচ্চিত্রটি দেখার পর দুই-তিন দিন তারা একধরনের ঘোরের মধ্যে ছিলেন, সাধনাকে মাথা থেকে বের করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সাধনার কথা চিন্তা করে তাদেরও হস্তমৈথুন করতে হয়েছে। বাকি একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘চলচ্চিত্রে যেভাবে বীর্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, সেটা আমার ভালো লেগেছে। তবে সাধনা-কৃপার সম্পর্কের উপস্থাপন আমার মোটেও ভালো লাগেনি।’

নারী শিক্ষার্থীদেরও একই ধরনের প্রশ্ন করা হয়। এদের মধ্যে দুই জন জানান, এর আগে তারা কখনোই এ ধরনের চলচ্চিত্র দেখেননি, এমনকি পর্নোগ্রাফিও না। ফলে কসমিক সেক্স দেখার পর তারা এটাকে মেনে নিতে পারছিলেন না; শেষ পর্যন্ত তারা বমি করে ফেলেন। এদের বাকি তিন জন চলচ্চিত্রে এ ধরনের বিষয় দেখানো ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন। কী এমন আছে এই চলচ্চিত্রে যা দেখে এইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই তিন নারী শিক্ষার্থীর একজন বলেন, ‘আসলে রুহুল ফকির সাধনাকে মা বলে ডেকে তার সঙ্গেই যেভাবে যৌনসঙ্গম করেছে সেটা আমার খুব খারাপ লেগেছে। যদি তার সঙ্গে সাধনা করতেই হয়, তাহলে মা না ডেকে অন্য কিছু ডাকতে পারতো। আর সাধনার সময় তারা যেভাবে সব কাপড় খুলে ফেলেছে, সেটা তো পর্নোগ্রাফির মতোই।’

তবে এই ১০ শিক্ষার্থীর অধিকাংশই মনে করে, কসমিক সেক্স দেখার পর বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণাই তৈরি হয়েছে। কারণ তারা মনে করতো, বাউল-ফকির মানেই একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। এটা জানা ও বোঝা নিয়ে তাদের অনেকেরই আলাদা একটা আগ্রহ ছিলো, কিন্তু চলচ্চিত্রটি দেখার পর মনে হয়েছে বাউল-ফকিররা বিকৃত যৌনাচার করে। আর তাদের সঙ্গে যেসব মেয়েরা থাকেন, তারাও সাধনার মতো গুরুর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেন। একই সঙ্গে তারা এ কথাও জানান যে, বাস্তবে তাদের দেখা বাউল-ফকিরদের সঙ্গে চলচ্চিত্রের বাউল-ফকিরদের কোনো মিল তারা পাননি।

অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক। যেকোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক মতামত জানার ক্ষেত্রে বিকল্প এই মাধ্যম বেশ কার্যকর। তাই চলচ্চিত্রটি নিয়ে ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মনোভাব জানার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার নিজের আইডিতে (ibrahimrumcj) লগ-ইন করে বাংলায় ‘কসমিক সেক্স’ লিখে অনুসন্ধান করা হয়। চলচ্চিত্রটি নিয়ে সেখানকার বেশ কয়েকজনের মন্তব্য এখানে হুবহু তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করছি। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে ফেইসবুকে ‘আনন্দ কুটুম’ লিখেছেন,

সরি ... কসমিক সেক্স, আপনি অনেক শিল্পসম্মত সিনেমা। অনেক আলোচিত। আধুনিক চলচ্চিত্রবোদ্ধারা আপনাকে পেয়ে অকুল পাথারে মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আপনাকে হজম করা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব। ... তবে কথা দিলাম আপনাকে হজম করিবার চেষ্টা অব্যাহত রাখিব। যদি নিতান্তই বদহজম হয়, তবে ক্ষমা করিবেন। মানুষের বসতিতে ঘুমাই তো ...।

‘বিস্মৃতি অতীতমুভি লাভারজ্ পোলাপাইন’ লিখেছেন,

দেখিব না দেখিব না করিয়া দেখিয়াই ফেললুম সেই বিখ্যাত, সমালোচিত, মাথার উপ্রে দিয়ে যাওয়া মুভি কসমিক সেক্স! অতঃপর আরেকবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলাম বাসায় অন্য কেউ না থাকার জন্যে। মাথার মোটামুটি ভিতরেই ঢুকছে, কিন্তু অভিনয় যথেষ্ট ভুয়া ছিল (ঋ সাহেবা ব্যতিত u knwo what i mean)। কাহিনী সক্কলেই জানেন তাই আরেকবার বলিয়া পীড়া দেবার কুনু দরকার বোধ করিতেছি না। তবে অভিনয় আরো রিয়ালিস্টিক হইত যদি প্রফেশনাল পর্নস্টার দিয়া অভিনয় করাইত! আমার জিন্দেগীর আরো প্রায় আড়াই ঘণ্টা বরবাদ হয়ে গেসে!!!

‘মাধবীলতার মৌ’ লিখেছেন, যে বাঙ্গালী ‘জিরো ডিগ্রী’ দেখে ছি! ছি! করে। তারাই আবার কসমিক সেক্স দেখে বাহ বাহ করে। সাধু সাধু! সেক্স, আধ্যাত্মিকতা আর স্বাধীনতা মিশালেই সব যায়েজ হয় বুঝি? নাকি, কেষনো কল্লে লিলা আর আমরা কল্লে বিলা। ছেনাল বাঙ্গালী।

‘রেজাউল হাসান’ লিখেছেন,

কসমিক সেক্স, গান্ডু যে ওপার বাংলা বানিয়ে পশ্চিমা নীল ছবিকেও ছাড়িয়ে গেছে, এটা জানানো, দেখানো, শিখানোই যে দেব গংদের উদ্দেশ্য সেটা পানির মত পরিস্কার আমাদের যুবকদের কাছে। তিস্তার জলে যে সানি লিওনের সব পোশাক ভেসে যাচ্ছে, কই বঙ্গ ললনারা তোমরা খুলছ না কেনো? বোরখা তো নিয়েছিই, শাড়ী ছিঁড়ে গেছে, সেলওয়ার কামিজ তো খুলেই নিচ্ছি, এখন পরাচ্ছি জিন্স গেঞ্জি। বাকি রইল যা ... তা খুলতে সমস্যা হচ্ছে? ঋ সেনকে দেখ সব শিখে যাবে।

‘লক্ষ্যভেদী ধনুর্ধারী’ লিখেছেন,

মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত না হলে এমন মুভিকে কেউ ভালো বলতে পারবে না। এখানে সমাজের স্বাভাবিকতাকে বিকৃত করা হয়েছে। এ মুভির একজায়গা তে তো বলা হয়েছে যে মানুষ নাকি ধর্মের দ্বারা অত্যাচারিত। আমি জানি না, পৃথিবীতে কোন্ ধর্ম মানুষকে অত্যাচার করার জন্য সৃষ্ট। আসলে এটা হলো আমার দেখা সবচেয়ে ফালতু মুভি।

আগেই বলেছি, ফকির শামসুল সাঁই ছাড়াও চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে মতামত জানতে আগেই বলেছি এই দর্শনে বিশ্বাসী আরো চার জনের সঙ্গে কথা বলা হয়। শামসুল সাঁইয়ের মতামত নেওয়ার জন্য মূলত প্রথমে ল্যাপটপে তাকে কসমিক সেক্স দেখানো হয়। এরপর তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা হয়। চলচ্চিত্রটি দেখার সময় শামসুল সাঁইয়ের সঙ্গে তার বেশ কয়েকজন শিষ্য ছিলেন। এদের মধ্যে একজন একেবারে নবীন, যিনি অল্প কিছুদিন হলো তার সঙ্গে সঙ্গ করছেন। চলচ্চিত্রটি দেখার পর ওই শিষ্যকে নিয়ে বেশ শঙ্কিত হয়ে সাঁইজি বলেন, ‘আমি আসলে না বুঝে নবীন ওই শিষ্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রটি দেখে ফেলেছি। এটা দেখে তার ভুল বোঝার সম্ভাবনা রয়েছে। তাকে যেভাবে এতদিন শিখিয়ে এসেছি সেটার আজ সম্পূর্ণ উল্টা দেখলো। চলচ্চিত্রটি যিনি নির্মাণ করেছেন, তার এগুলো এভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেওয়া মোটেও উচিত হয়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘কসমিক সেক্স-এ যা দেখানো হয়েছে তার দু-একটি বিষয় ছাড়া দ্বিমত পোষণ করা মুশকিল। তবে মারফতি তত্ত্বের এ বিষয়গুলো গুরু-শিষ্যের একান্ত গোপনীয় ও কঠিন। এটা বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করবে।’

অন্য চার জন (এদের মধ্যে একজন সিঙারা-পুরি বিক্রেতা, দুই জন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও আরেকজন যশোরের চৌগাছার ফকিরি দর্শনের অনুসারী) চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে যা বলেন তা একসঙ্গে করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, তারা যে বিষয়গুলো গুরুকে ধরে দিনের পর দিন অনেক কষ্ট করে শিখেছেন, তা এখানে এতো সহজভাবে দেখানো হয়েছে, যেনো দেহ সাধনা কোনো ব্যাপারই নয়; যে কেউ এটা চাইলেই করতে পারে। এছাড়া এ চলচ্চিত্র দেখে সাধারণ মানুষ বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করবে। একই সঙ্গে তারা মন্তব্য করেন যে, যিনি এ চলচ্চিত্রটি বানিয়েছেন, তিনি বাউল-ফকিরদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সবকিছু জানার পর সেগুলো প্রকাশ করে তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন।

দম ফেলার আগে

মধ্যযুগে সৃষ্ট বাউল-ফকিরের সাধনা আজ অবধি অধিক গোপনেই পরিচালিত। এই গোপনীয়তা যশোরের ফকির মিজানুর রহমানের ভাষায়,

মারফত তত্ত্বের কথা যদি শুধু একজন সঙ্গীর সঙ্গেও কোনো গাছের নীচে বসে আলোচনা করতে হয়, তাহলে কথা শুরুর আগে গাছে একটি ঢিল মারতে হবে। যদি গাছে কোনো পাখি থাকে তাহলে সেটা যেনো উড়ে যায়। কারণ একটি পাখিও যদি গোপন এ তত্ত্ব শোনে তাহলে সেটা অন্যের কাছে প্রকাশ হয়ে যেতে পারে।

সাধনার এ গোপনীয়তা ঠিক কেনো, কীসেরইবা ভয়-সে প্রশ্নের উত্তর বাউল-ফকিররাই দিতে পারবেন। কিন্তু যে কথাটি এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, তথ্য ও প্রযুক্তির চরম বিকাশের এই সময়ে কোনো কিছু এভাবে গোপন রাখা আদৌ সম্ভব কি না? প্রযুক্তির কল্যাণে যেখানে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো তথ্য, অবস্থান জানা ও দেখা সম্ভব, সেখানে বাউল সাধনার এই গোপনীয়তা তো নস্যি! যে কেউ চাইলেই ইন্টারনেট ঘেঁটে মুহূর্তেই খোঁজ পেতে পারেন বাউল-সাধনা ও তার রকমফেরের।

অন্যদিকে সাধনা যদি মুক্তি লাভ বা ঈশ্বরকে পাওয়ার একমাত্র পথ হয়, তাহলে সে সাধনা গোপন রাখার উদ্দেশ্যই কী? তাহলে এ দর্শনে গোপন করাটা সাধনা, নাকি সাধনা করাই সাধনা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে অবস্থা দাঁড়ায়, তাতে কসমিক সেক্স নিয়ে নির্মাতা অমিতাভের হয়তো খুব একটা ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অমিতাভ এই সাধনাকে পর্দায় বৃহৎ মানুষের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করবেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর সেখানেই মনে হয় নির্মাতা হিসেবে অমিতাভের ব্যর্থতা।

লেখক : ইব্রাহীম খলিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন।

ibrahimrumcj@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. ওয়ালী, মৌলবী আবদুল (১৯৯৯ : ২৬); ‘বাউল-ফকির বিষয়ে বাঙালির প্রথম সরেজমিন লেখা’; বাংলার বাউল ফকির; সম্পাদনা : সুধীর চক্রবর্তী; পুস্তক বিপণি, কলকাতা।

২. ইসলামকে জানা, বোঝা ও মানার ক্ষেত্রে শরিয়ত, মারফত, তরিকত ও হকিকত-এ চারটি স্তর সর্বজন স্বীকৃত। শরিয়ত ইসলামের পরিচয় এবং মনে প্রাণে মেনে নেওয়ার বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান। যদি কেউ ইসলামের শরিয়ত না মানে, তাহলে সে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী ইসলামের অননুসারী বা কাফের। অন্যদিকে মারফত, তরিকত ও হকিকত-এ তিনটি স্তরকে ‘আধ্যাত্মিক’ জগৎ হিসেবে গণ্য করা হয়।

৩. মামুন, আ. আল; ‘মনের মানুষ : বেশরা ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে ভদ্দরলোকদের সূক্ষ্ম প্রেমের মর্ম বোঝা ভার!!’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ১, সংখ্যা ১, জুলাই ২০১১, পৃ. ৭৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

৪. চক্রবর্তী, সুধীর (১৯৮৯ : ৯৪); গভীর নির্জন পথে; আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা।

৫. https://tinyurl.com/bdfxshsh

৬. https://tinyurl.com/2k72b64f

৭. চাকী, লীনা (২০০১ : ৫১); বাউলের চরণ দাসী; পুস্তক বিপণি, কলকাতা।

৮. প্রাগুক্ত; চক্রবর্তী, সুধীর (১৯৮৯ : ২৪৪)।

৯.  https:/ww/w.youtube.com/watch?v=uP0eAJZwW9g

১০. https:/ww/w.youtube.com/watch?v=tk2wLD1lkOc



বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।




এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন